বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:০৬ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 4 minutes
খেলাধুলা, সারাবাংলা ডেক্স:
মঙ্গলবার কাতার বিশ্বকাপের ‘সি’ গ্রুপের ম্যাচে লুসাইল স্টেডিয়ামে র্যাংকিংয়ের তিনে থাকা আর্জেন্টিনাকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়েছে ৫১তম স্থানে থাকা সৌদি আরব। আলবেসিলেস্তেদের বিপক্ষে এটিই প্রথম জয় দলটির। একইসঙ্গে আর্জেন্টিনার টানা ৩৬ ম্যাচের অপরাজিত দৌড় থামিয়ে দিল সৌদি ফুটবল দল।
র্যাঙ্কিংয়ের ৫১ নম্বরে থাকা এশিয়ান দেশটির কাছে অঘটনের শিকার হয়েছে র্যাঙ্কিংয়ের ৩ নম্বরে থাকা আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার কট্টর বিরোধীরাও হয়ত কল্পনা করতে পারেনি এমন অঘটনের।
প্রথমার্ধে লিওনেল মেসির পেনাল্টি গোলে ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়ার্ধে ২ গোল হজম করে। এই হারে শেষ হলো আর্জেন্টিনার টানা ৩৬ ম্যাচের অপরাজেয় যাত্রা। ‘সি’ গ্রুপের ম্যাচে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে ২-১ গোলে জিতেছে সৌদি আরব। ম্যাচজুড়ে একের পর এক আক্রমণ করে সৌদির রক্ষণভাগের পরীক্ষা নেয় আর্জেন্টিনা। তবে গোলপোস্টে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মোহামেদ আল ওয়াইসকে ফাঁকি দিতে পারেনি তারা। প্রথমার্ধে পেনাল্টি থেকে গোল করে যদিও দলকে এগিয়ে নেন মেসি। তবে দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমে সৌদির সালেহ আল সেহরি সমতা টানার পাঁচ মিনিট পর দলকে এগিয়ে নেন সালেম আল-দাওয়াসরি। শুরু থেকেই দাপট দেখিয়েছিল আর্জেন্টিনা। তবে থেমে ছিল না সৌদি আরবও। সুযোগ পেলেই আক্রমণ সাজাতে ভুল করতো না দলটি। গোল পেতে অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি আলবেসিলেস্তাদের। দশম মিনিটে পেনাল্টি পেয়ে সফল স্পট কিকে বল জালে জড়ান লিওনেল মেসি। এর আগে অষ্টম মিনিটে কর্ণার কিকের সময় বক্সে থাকা পারেদেসকে ফাউল করেন আল-বুলায়াহি।
এদিন ম্যাচের দশম মিনিটে লিওনেল মেসির সফল স্পট কিকে প্রত্যাশিতভাবেই এগিয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। এরপর প্রথমার্ধে আরও তিনবার বল জালে পাঠায় তারা। কিন্তু অফসাইডের কারণে কোনোটিতেই মেলেনি গোল।
টানা সবচেয়ে বেশি ৩৭ ম্যাচ জয়ের রেকর্ড গড়ার পথে থাকা আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়ার্ধে হারিয়ে ফেলে খেই। ৬ মিনিটের ব্যবধানে ২ গোল খেয়ে পিছিয়ে যে পড়ে তারা, এরপর অনেকটা সময় থাকলেও পারেনি ঘুরে দাঁড়াতে। ৪৮ মিনিটে ডি-বক্সে বল পেয়ে আড়াআড়ি শটে গোল করে সৌদি আরবকে সমতায় ফেরান সালেহ আল শেহরি। সেই ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই দ্বিতীয় গোল খেয়ে বসে আর্জেন্টিনা। ৫৩তম মিনিটে ডি-বক্সের মাথায় আলগা বল পেয়ে তিন জনকে কাটিয়ে বুলেট গতির শটে দলকে এগিয়ে নেন সেলিম আল দাওয়াসারি। দারুণ এক বাঁকানো শটে আর্জেন্টিনার জালে বল পাঠান এই মিডফিল্ডার। লাফিয়েও বলের নাগাল পাননি এমিলিয়ানো মার্তিনেস। শেষদিকে বেশ কয়েকটি আক্রমণ করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু সৌদি গোলরক্ষক আল ওয়াইস দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন গোলপোস্টের সামনে। একের পর এক দুর্দান্ত সেভ দিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়েন তিনি। আর্জেন্টিনাকে হারানোর ম্যাচে সৌদি আরবের পরিকল্পনা ছিল নজরকাড়া। ফলও পেয়েছে তারা। টুর্নামেন্টের ফেভারিট হিসেবে শুরু করা আলবিসেলেস্তেদের দিয়েছে হারের স্বাদ।
মেসিদের এই হারের পরই আলোচনা শুরু হয়েছে, ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটাই কী তবে সবচাইতে বড় অঘটন? পরিসংখ্যানই বা কী বলছে? ফুটবলে তো এর আগেও এমন অনেক অঘটনের ঘটনা ঘটেছে। তাহলে সৌদির কাছে আর্জেন্টাইনদের এই হারের অঘটনকে কোথায় স্থান দেওয়া যায়? পরিসংখ্যানের তথ্য বা ডাটা নিয়ে কাজ করে একটি বিখ্যাত কোম্পানি, নিয়েলসেন গ্রেসনোট। তারা তাৎক্ষণিক তথ্য-পরিংখ্যান ঘেঁটে এবং পর্যালোচনা করে জানাচ্ছে, ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সৌদি আরবের কাছে আর্জেন্টিনার পরাজয়ের এই ঘটনাই সবচেয়ে বড় আপসেট বা অঘটন।
গ্রেসনোটের সেরা আপসেটের ঘটনাগুলোর মধ্যে ১ম স্থানে রয়েছে সৌদির কাছে আর্জেন্টিনার পরাজয়–
১ম: আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সৌদি আরবের ২-১ গোলে জয়। এই ম্যাচের আগে সৌদি আরবের জয়ের সম্ভাবনা ছিল কেবল ৮.৭ শতাংশ।
২য়: ১৯৫০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ১-০ গোলে জয়। ওই ম্যাচের আগে যুক্তরাষ্ট্রের জয়ের সম্ভাবনা ছিল ৯.৫ শতাংশ।
৩য়: ২০১০ বিশ্বকাপে স্পেনের বিপক্ষে সুইজারল্যান্ডের ১-০ গোলে জয়। ম্যাচের আগে সুইসদের জয়ের সম্ভাবনা ছিল ১০.৩ শতাংশ।
৪র্থ: ১৯৮২ বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে আলজেরিয়ার ২-১ গোলে জয়। ওই ম্যাচের আগে আলজেরিয়ার জয়ের সম্ভাবনা ছিল ১৩.২ শতাংশ।
৫ম: ২০০৬ সালে চেক রিপাবলিকের বিপক্ষে ঘানার ২-০ গোলে জয়। ম্যাচের আগে ঘানার জয়ের সম্ভাবনা ছিল ১৩.৯ শতাংশ।
৬ষ্ঠ: ১৯৫০ সালের শেষ ম্যাচে ব্রাজিলের বিপক্ষে উরুগুয়ের ২-১ গোলে জয়। ম্যাচের আগে উরুগুয়ের জয়ের সম্ভাবনা ছিল ১৪.২ শতাংশ।
৭ম: ২০১৮ সালে জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। ম্যাচের আগে কোরিয়ানদের জয়ের সম্ভাবনা ছিল ১৪.৪ শতাংশ।
৮ম: ১৯৫৮ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরিকে ২-১ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল ওয়েলস। ওই ম্যাচের আগে ওয়েলসের জয়ের সম্ভাবনা ছিল ১৬.২ শতাংশ।
৯ম: ১৯৮২ সালে স্পেনকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল উত্তর আয়ারল্যান্ড। ম্যাচের আগে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সম্ভাবনা ছিল ১৬.৫ শতাংশ।
১০ম: ২০০২ সালের উদ্বোধনী ম্যাচে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল সেনেগাল। ম্যাচের আগে সেনেগালের জয়ের সম্ভাবনা ছিল ১৭.৩ শতাংশ।
কে এই হার্ভে রজার রেনার্ড:
সৌদি আরবের কোচের নাম হার্ভে রজার রেনার্ড। সৌদি আরবের এই কোচের জন্ম ফ্রান্সে। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময়ই ছোট ক্লাবগুলোতে কাজ করেছেন তিনি। ১৯৯৯ সালে নিজের কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি ফরাসি ক্লাব এসসি দ্রাগোনিগানের হয়ে। তাদের টানা দুই মৌসুমে প্রমোশন এনে দিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডের তৃতীয় বিভাগের দল ক্যামব্রিজ ইউনাইটেডের দায়িত্ব নিতে। ওখানেও খুব বেশি দিন স্থায়ী হননি। ভিয়েতনামের ক্লাবে হয়ে ফিরে আসেন ফ্রান্সের পঞ্চম বিভাগের দল এএস চেরবুর্গের দায়িত্ব নিতে। এতগুলো ক্লাব বদলেও একটি জায়গায় ঠিক থেকেছেন তিনি- রেনার্ডের দলের খেলার ধরনে এসেছে উন্নতি। এগুলোর জন্য মাঠের সঙ্গে বাইরেও কিছু বদলের নিয়ম জারি করে থাকেন তিনি। খাবার থেকে শুরু করে ফিটনেস, ম্যাচের পর রিকোভারিতে গুরুত্ব দেন। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের দায়িত্ব নেন তিনি। তবে ততদিনে তার ঝুলিতে আছে আন্তর্জাতিক সাফল্যও। ২০১২ সালে জাম্বিয়া ও ২০১৫ সালে আইভেরি কোস্টকে নিয়ে আফ্রিকান কাপ অব নেশন্স জেতান। এরপর ২০১৮ সালে ২০ বছর পর মরোক্কোকে বিশ্বকাপে তুলে আনেন রজার। এবার তো বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চমকে দিলো তার দল।
১৯৭৪ বিশ্বকাপের পর এই প্রথম কোন বিশ্বকাপে নিজেদের শুরুর ম্যাচে ২ গোল খেল আলবিসেলেস্তেরা। ২০১৯ এর কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে হারার পর এই প্রথম কোন ম্যাচ হারলো আর্জেন্টিনা।
বিশ্ব সেরার মঞ্চে ৩৬ বছরের শিরোপা খরা কাটাতে এসে এখন গ্রুপ পর্বের বিতরণী পার হওয়ার পথই কঠিন হয়ে গেছে আর্জেন্টিনার জন্য। পরের দুই ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ মেক্সিকো ও পোল্যান্ড। এই দুই ম্যাচে নিজেদের সর্বোচ্চটা উজাড় করে দিয়ে পরের ধাপে যাওয়ার প্রত্যয় মেসির কণ্ঠে।
র্যাঙ্কিংয়ে ৪৮ ধাপ পিছিয়ে থাকা সৌদি আরবের বিপক্ষে প্রিয় দল হেরে যাবে, সেটা বোধহয় কল্পনাও করেননি তারা। দলটির বেশিরভাগ সমর্থকেরই হয়তো একই অবস্থা। অধিনায়ক লিওনেল মেসি অবশ্য বলছেন, এশিয়া দলটির এমন পারফরম্যান্সে অবাক নন তারা। দ্বিতীয়ার্ধের খেলায় দল ভুল করেছে বলে মনে করেন তিনি।
ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে এর আগে সবচেয়ে বড় অঘটন হিসেবে ধরা হতো ১৯৫০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়কে।